রুবি পরিবার বিতর্কিত ছিল, তবু আইন নিজের হাতে তোলার দায় কে নেবে?
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, কুমিল্লা: কুমিল্লার মুরাদনগরের বাঙ্গরা বাজার থানাধীন কড়ইবাড়ী গ্রামে গণপিটুনিতে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত রোকসানা বেগম রুবি, তার মেয়ে জোনাকি আক্তার ও ছেলে রাসেল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পুরো দেশজুড়ে নিন্দা ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। খোদ গ্রামেই তৈরি হয়েছে শূন্যতা পুরুষরা পালিয়ে গেছেন, অনেক বাড়িতে তালা ঝুলছে, আতঙ্কে দম বন্ধ হওয়া পরিবেশ। অথচ শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি, হয়নি গ্রেপ্তারও।
পূর্বপরিকল্পিত বৈঠক ছিল হত্যার ভিত্তি
স্থানীয় সূত্র ও নিহতদের স্বজনদের ভাষ্যমতে, হত্যাকাণ্ডটি কোনো তাৎক্ষণিক ঘটনার ফল নয়; বরং আগের রাতে অন্তত তিন দফা বৈঠক হয়। এসব বৈঠকের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কড়ইবাড়ী গ্রামের বাছির মিয়া। তাকে খুঁজছে পুলিশ। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আরও কয়েকজন গ্রাম্য মাতব্বর, যারা রুবি পরিবারকে “শিক্ষা দিতে” চেয়েছিলেন। স্থানীয়রা বলছেন, এর পেছনে রুবি পরিবারের দীর্ঘদিনের মাদক কারবার, জমি দখল, হয়রানি, ও মিথ্যা মামলার ভূমিকা রয়েছে।
মোবাইল চুরি: উত্তেজনার সূচনা
ঘটনার সূত্রপাত হয় স্থানীয় স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিনের মোবাইল চুরিকে ঘিরে। অভিযোগ, রুবির মেয়ের জামাই মনির হোসেনের সহযোগী মারুফ মোবাইলটি চুরি করে। তাকে ডেকে আনা হয় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লালের কার্যালয়ে। সেখানেই রুবি উপস্থিত হয়ে চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়াকে মারধর ও অপমান করেন। এরপর থেকেই এলাকার পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
বৃহস্পতিবার সকাল: উত্তেজনা ও হামলা
পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শতাধিক মানুষ রুবির বাড়ির আশপাশে জড়ো হতে থাকে। ইট-পাটকেল ছোড়ার পর হামলা শুরু হয়। শিশুদের সরিয়ে রেখে হামলাকারীরা রুবিকে উঠানে ফেলে পেটাতে থাকে। পাশে থাকা তার মেয়ে ও ছেলেকে একইভাবে হত্যা করা হয়। গুরুতর আহত হন আরেক মেয়ে রুমা আক্তার।
নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, “বুধবার রাতে বাছির মিয়া ফোন করে হুমকি দেয়। বলে ‘তোর পরিবারকে শেষ করে দেব’। পরদিন সকালেই আমরা সর্বনাশ হয়ে গেলাম।”
তিনি আরও বলেন, “আমার স্বামী রাসেল জীবন ভিক্ষা চাইছিল, বলছিল আমার একটা ছোট সন্তান আছে। কিন্তু কেউ শুনল না। চেয়ারম্যান শিমুল ও মেম্বার বাচ্চুসহ কয়েকজন এসব ঘটনার পেছনে ছিলেন।”
পুরুষশূন্য গ্রাম, সামাজিক নিস্তব্ধতা
গণপিটুনির পর পুরো কড়ইবাড়ী গ্রামে পুরুষ বলতে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। দোকানপাট বন্ধ, মসজিদে লোক কম, রাস্তাঘাট ফাঁকা। ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, স্থানীয় শিক্ষকরাও গা ঢাকা দিয়েছেন।
রুবি পরিবার: বিতর্কিত অতীত
স্থানীয়দের ভাষ্যে, রুবি প্রায় দুই যুগ ধরে মাদক কারবারে জড়িত ছিলেন। তার পরিবারে প্রায় সবাই—স্বামী, সন্তান, মেয়ের জামাই মাদকের সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ একাধিকবার গ্রেপ্তার করলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার সেই পথেই ফিরতেন। এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে অন্তত ৮২টি মামলা করেছিলেন রুবি। তবে এসবও কোনো হত্যার বৈধতা দেয় না এমন মত অনেক স্থানীয়েরও।
জানাজায় অনীহা, কবর খোঁড়েন গ্রাম পুলিশ
শুক্রবার রাত ৯টার দিকে গ্রাম পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে লাশ কবরস্থানে পৌঁছায়। জানাজায় অংশ নেননি স্থানীয়রা। অবশেষে গ্রাম পুলিশের ৩ সদস্য এবং একজন স্বজন কবর খুঁড়ে দাফনের ব্যবস্থা করেন।
পুলিশ বলছে: তদন্ত চলছে, ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহে
বাঙ্গরা বাজার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, “আমরা ঘটনার পেছনে যে পরিকল্পিত চক্রান্ত আছে তা মাথায় রেখেই তদন্ত করছি। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ চলছে। কারা নেতৃত্ব দিয়েছে, কারা মাইকিং করেছে, সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথাও হয়েছে। তারা রাতেই মামলা দায়ের করবে বলেছে।”
তিনি আরও বলেন, “ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও ইন্ধনদাতাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। এজহার পাওয়ার পর দ্রুত গ্রেপ্তার শুরু হবে।”
নতুন করে প্রশ্ন: আইন নিজের হাতে তোলা কি সমাধান?
যদিও রুবি ও তার পরিবার মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে, কিন্তু তাদের হত্যা করে জনতার বিচার প্রশ্নবিদ্ধ। বরং এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচারকে আরো দুর্বল করে। তদুপরি, এমন ঘটনার পর গ্রামে নিরবতা ও ভয়-সেটাও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার এক প্রতিচ্ছবি।










