Home Second Lead ধর্ম উপদেষ্টার যুগান্তকারী ঘোষণা: টেকনোক্র্যাট মন্ত্রিত্বে ‘না’, অর্ডিনেন্সের প্রস্তাব

ধর্ম উপদেষ্টার যুগান্তকারী ঘোষণা: টেকনোক্র্যাট মন্ত্রিত্বে ‘না’, অর্ডিনেন্সের প্রস্তাব

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

আমি এক টাকার দুর্নীতি করিনি: ড. খালিদ

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেবেন না বলে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন।

শনিবার (২৫ অক্টোবর) দৈনিক নয়াদিগন্তের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে তার এই মন্তব্য রাজনীতি ও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে চলমান বিতর্কের মাঝে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তার এই অবস্থান একদিকে ‘উপদেষ্টাদের নিরাপদ প্রস্থান’ সংক্রান্ত গুঞ্জনকে চ্যালেঞ্জ করেছে, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ সরকার গঠনে টেকনোক্র্যাটদের ভূমিকা নিয়ে একটি নতুন ধারা প্রস্তাব করেছে।

‘নিরাপদ প্রস্থানের প্রয়োজন নেই’ এবং ‘অর্ডিনেন্সের প্রস্তাব’:
ড. খালিদ হোসেনের মন্তব্য, “আমি একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বলা হচ্ছে যে উপদেষ্টারা সেফ এক্সিট চান। সেফ এক্সিট তো আমার প্রয়োজনই নেই।”—এটি উপদেষ্টাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চলমান জল্পনা-কল্পনার সরাসরি জবাব।

তিনি উপদেষ্টাদের নিয়ে যে ‘নিরাপদ প্রস্থান’ চাওয়ার গুঞ্জন রয়েছে, তা উড়িয়ে দিয়েছেন। বরং তিনি তার সহকর্মী ফাওজুল কবির খানের প্রস্তাবকে সমর্থন করে বলেছেন, একটি অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে বর্তমান উপদেষ্টাদের আগামী নির্বাচিত সরকারে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব না নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত। এটি উপদেষ্টাদের নিরপেক্ষতা ও ক্ষমতার প্রতি তাদের অনীহার একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে।

এই প্রস্তাবটি যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নজির স্থাপন করতে পারে, যেখানে অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের সদস্যরা পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারের অংশ হতে অনীহা প্রকাশ করছেন।

টেকনোক্র্যাট মন্ত্রিত্বে দৃঢ় অস্বীকৃতি:
ড. খালিদ হোসেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হলো, তিনি কোনো নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেবেন না, এমনকি যদি তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তার এই বক্তব্য উপদেষ্টাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চলমান বিতর্কে একটি স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দেয়।

তিনি বলেছেন, “আগামী সরকারে যদি আমাকে ইনভাইট করে, সম্মান জানায়… আমি তাদের প্রতি যথার্থ সম্মান জানিয়ে কেবিনেটের অংশ হবো না।” তার এই ঘোষণা উপদেষ্টাদের ভূমিকা ও তাদের ক্ষমতার প্রতি নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক বলে মনে করা হচ্ছে।

ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টার সেক্যুলার রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা:
ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা হয়েও ড. খালিদ হোসেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে “কমপ্লিটলি সেকুলার স্টেট, লিগেছি ফ্রম দ্য ব্রিটিশ রেজিম” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তহবিল সরকারি অর্থায়ন থেকে আসে এবং এর বিতরণ শরিয়া অনুযায়ী নয়।

তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, শরীয়ত ব্যক্তিগতভাবে পালন করার বিষয় এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে তাকে বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়ে যেতে হয়। তার এই ব্যাখ্যা ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের গুরুত্ব তুলে ধরে। তার বক্তব্য, “আমি যতদিন দায়িত্বে থাকবো যাওয়াটা আমার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে আমরা ঘরে চলে যাবো। তখন আমি মন্দিরে যাবো না, তখন এটা আমার ডিউটি নয়।”—এটি ধর্ম বিষয়ক দায়িত্বের রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত দিকগুলোকে পৃথকভাবে উপস্থাপন করে।

১৫ মাসের কাজের মূল্যায়ন ও দুর্নীতির অভিযোগ খণ্ডন:
ড. খালিদ হোসেন তার ১৫ মাসের দায়িত্বকালের মূল্যায়ন চেয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি এক টাকার দুর্নীতি করিনি।” তার এই দাবি জনসমক্ষে তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তুলে ধরার একটি প্রচেষ্টা। তিনি হাজিদের সাড়ে আট কোটি টাকা ফেরত দেওয়া এবং সৌদি আরবে আটকে থাকা এজেন্সিগুলোর ৩৯ কোটি টাকা বিতরণ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে, ১৬-১৭ বছরের ঝঞ্জাল দেড় বছরে পরিষ্কার করা কঠিন, তবে তারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব:
ফেসবুকে তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়াকে তিনি “সীমা থাকা উচিত” বলে মন্তব্য করেছেন, যা সমাজের একটি অংশের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের প্রতি তার হতাশা প্রকাশ করে। এটি জনপরিসরে ভুল তথ্যের দ্রুত বিস্তার এবং তার ব্যক্তিগত প্রভাবের একটি ইঙ্গিত দেয়।

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনের এই ঘোষণা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি কেবল একজন উপদেষ্টার ব্যক্তিগত অনীহাই প্রকাশ করে না, বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা এবং ক্ষমতার প্রতি নির্মোহ থাকার একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনের ইঙ্গিত দেয়। তার ‘অর্ডিনেন্স’ প্রস্তাব যদি বিবেচিত হয়, তবে এটি টেকনোক্র্যাটদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা সীমিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। একইসাথে, একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রে ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টার ব্যাখ্যা এবং তার স্বচ্ছতা ও নিষ্ঠার দাবি, বর্তমান অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করে।