Home শিক্ষা স্বপ্নের পিছুছুটে ব্ল্যাক ফরেস্টের দেশে: লড়াকু একঝাঁক বাংলাদেশি তরুণ

স্বপ্নের পিছুছুটে ব্ল্যাক ফরেস্টের দেশে: লড়াকু একঝাঁক বাংলাদেশি তরুণ

অরিন্দম বণিক, বার্লিন: ঢাকার জার্মান দূতাবাসের সামনের সেই দীর্ঘ লাইনটা এখন অনেকের কাছেই অতীত। মাসের পর মাস অপেক্ষার প্রহর গুনে যারা শেষ পর্যন্ত জার্মানির মাটিতে পা রেখেছেন, তাদের জীবনটা এখন বদলে গেছে অনেকটা। কেউ বার্লিনের কনকনে ঠান্ডায় লাইব্রেরিতে বসে থিসিস লিখছেন, কেউ বা মিউনিখের কোনো ক্যাফেতে কাজের ফাঁকে মনে করছেন মা-র হাতের ভাতের স্বাদ।

শহর জুড়ে বাংলাদেশিদের পদচিহ্ন জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি। বিশেষ করে বার্লিন, মিউনিখ, হামবুর্গ আর স্টুটগার্টের মতো শহরগুলোতে হাঁটলে প্রায়ই চেনা বাংলা ভাষা কানে আসে। টিউ মিউনিখ (TUM) বা ডার্মস্টাডের মতো নামী টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিগুলোতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা মেধাবীদের বড় একটা অংশই আমাদের দেশি তরুণ।

জীবন যেখানে যুদ্ধের নাম বাইরে থেকে জার্মানির জীবনটা যতটা ঝলমলে মনে হয়, ভেতরটা ততটাই লড়াকু। বার্লিনে পড়া এক শিক্ষার্থী বলছিলেন, “এখানে ফ্রি টিউশন ফি মানে এই না যে জীবনটা সহজ। আবাসন সংকট আর ভাষার দেয়াল টপকাতে আমাদের প্রতিটি দিনই একটা যুদ্ধ।” তারপরও কেউ হাল ছাড়ছেন না। পার্ট-টাইম কাজ শেষে রাত জেগে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়ে তারা ঠিকই নিজেদের প্রমাণ করছেন।

কেন এই অদম্য যাত্রা? জার্মানির বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পড়াশোনা শেষে কর্মসংস্থানের সুযোগই মূলত শিক্ষার্থীদের টেনে আনছে। এখানে মেধার মূল্যায়ন হয় সরাসরি। তাই ভিসা পেতে দেরি হলেও বা প্রতিকূলতা থাকলেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা জার্মানিকেই তাদের স্বপ্নের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।

“সংগ্রাম আছে, কিন্তু সম্ভাবনাও বিশাল” — জাহিদুল ইসলাম

প্রতিবেদনটির প্রস্তুতির সময় আমরা কথা বলেছিলাম বার্লিনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেটা সায়েন্স নিয়ে মাস্টার্স করা শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলামের সাথে। তার কথায় ফুটে উঠেছে জার্মানির প্রবাস জীবনের আসল চিত্র।

প্রশ্ন: ভিসা পেতে তো অনেক সময় লেগেছিল আপনার, সেই সময়টা কেমন ছিল? জাহিদ: হ্যাঁ, প্রায় দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। একবার মনে হয়েছিল অন্য কোথাও চলে যাই। কিন্তু জার্মানির পড়াশোনার মান আর স্কোপের কথা ভেবে হাল ছাড়িনি। এখন মনে হয়, সেই ধৈর্যটা বৃথা যায়নি।

প্রশ্ন: এখানে আসার পর প্রথম চ্যালেঞ্জ কী ছিল? জাহিদ: আবাসন। জার্মানির বড় শহরগুলোতে থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়া খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার মতো। তবে আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটি অনেক হেল্পফুল। ফেসবুক গ্রুপগুলোর মাধ্যমে বড় ভাইদের সহায়তায় থাকার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল।

প্রশ্ন: পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট-টাইম কাজ করা কতটা কঠিন? জাহিদ: পড়াশোনার চাপ এখানে অনেক বেশি। তবে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ করে নিজের থাকার খরচ অনায়াসেই চালানো যায়। আমি বর্তমানে একটি আইটি ফার্মে ‘ওয়ার্কিং স্টুডেন্ট’ হিসেবে আছি। এতে পড়ার খরচও উঠছে, আবার প্রফেশনাল অভিজ্ঞতাও হচ্ছে।

প্রশ্ন: নতুন যারা আসতে চায়, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? জাহিদ: আমি বলব, দেশ থেকে যতটা সম্ভব জার্মান ভাষাটা শিখে আসুন। ভাষা জানলে এখানে কাজ পাওয়া এবং মানুষের সাথে মেশা অনেক সহজ হয়। আর মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন যে, এখানে সবকিছু নিজেকেই করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, জার্মানি কেবল একটি দেশ নয়, বরং হাজারো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর কাছে এটি তাদের সামর্থ্য প্রমাণের এক বিশাল ক্যানভাস। লোহিত-রক্তিম পাসপোর্ট হাতে নিয়ে যে তরুণেরা আজ বার্লিন বা মিউনিখের রাজপথে হাঁটছেন, তারা শুধু উচ্চশিক্ষাই নিচ্ছেন না, বরং বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের এক একজন অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছেন। ভিসা জটিলতা, ভাষার দেয়াল কিংবা কনকনে শীতের রাত—কোনো কিছুই তাদের দমাতে পারছে না। বরং এই প্রতিটি বাধা যেন তাদের আরও পোক্ত করে গড়ে তুলছে। জার্মানির শিক্ষা আর গবেষণার এই পথ বেয়েই আগামীর বাংলাদেশ হয়তো বিশ্বমঞ্চে নতুন কোনো লিডার খুঁজে পাবে।

প্রবাসের মাটিতে আমাদের এই সূর্যসন্তানদের সাফল্য কেবল তাদের পরিবারের নয়, বরং গোটা বাংলাদেশের গর্ব। তাদের এই অদম্য যাত্রাকে স্যালুট।