ডাকপিয়নের গল্প, পোস্ট অফিসের নীরবতা এবং শেষ চিঠির অপেক্ষা
আমিরুল মোমেনিন, ঢাকা: একটা সময় ছিল, যখন ডাকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টা শুনলেই বুকের ভেতর কেমন করে উঠত। চিঠি এসেছে কি না—এই প্রশ্নে কেটে যেত সকাল, দুপুর, বিকেল। মোটা বাদামি খামের ভেতর লুকিয়ে থাকত সুখ, দুঃখ, অপেক্ষা, কখনো বা চোখের জল। আজ সেই চিঠির দিন নেই, ডাকপিয়নেরও নেই আগের মতো ব্যস্ততা।
গ্রামের প্রতিটি মানুষ ডাকপিয়নকে চিনত নাম ধরে। কার বাড়িতে অসুস্থতা, কোথায় বিয়ে, কার ছেলে শহরে কাজ পেয়েছে—সব খবরই যেন ডাকপিয়নের ঝোলায়। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের অবসরপ্রাপ্ত ডাকপিয়ন আবদুল করিম বলেন, “একদিনে পঁচিশ থেকে তিরিশটা চিঠি বিলি করতাম। কেউ বলত, বসো এক কাপ চা খাও। আমি শুধু চিঠি দিতাম না, খবরও নিয়ে যেতাম।”
চিঠির ভাষা ছিল আলাদা। প্রেমিকের চিঠিতে থাকত লাজুক শব্দ, প্রবাসীর চিঠিতে থাকত সংসারের টান, মায়ের হাতে লেখা চিঠিতে থাকত দোয়া আর শাসন একসঙ্গে। অনেকেই চিঠি খুলে পড়তে পারতেন না। তখন ডাকপিয়নই হয়ে উঠতেন পাঠক। সেই পাঠের সময় চারপাশে নেমে আসত নীরবতা।
পোস্ট অফিস ছিল গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। মাসে একদিন মানি অর্ডার এলে ভিড় জমত। চিঠি আসবে এই আশায় মানুষ অপেক্ষা করত দিনের পর দিন। কেউ কেউ পোস্ট অফিসের বারান্দায় বসে থাকত শুধু একটি খামের আশায়। আজ সেই পোস্ট অফিসে নীরবতা। দেয়ালে ঝোলানো পুরনো ঘড়িটাও যেন থেমে আছে।
মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, তাৎক্ষণিক বার্তা—সব মিলিয়ে চিঠির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আবদুল করিম আক্ষেপ করে বলেন, “এখন কেউ অপেক্ষা করে না। সব খবর মুহূর্তেই পেয়ে যায়। কিন্তু সেই আবেগ আর নেই।”
চিঠি শুধু যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না, ছিল সময়ের সাক্ষী। সেই খামে লেগে থাকত মাটির গন্ধ, ঘামের গন্ধ, কখনো আতরের হালকা ছোঁয়া। আজ ডিজিটাল পর্দায় শব্দ আসে, যায়—কিন্তু রেখে যায় না কোনো চিহ্ন।
ডাকপিয়নের সাইকেল থেমে গেছে বহু পথেই। শেষ চিঠির অপেক্ষায় যারা ছিল, তারা হয়তো এখনো আছে—কিন্তু চিঠি আর আসে না।
এ ধরণের আরও গুরুত্বপূর্ণ আপডেট পেতে ভিজিট করুন www.businesstoday24.com










