Home আন্তর্জাতিক  প্যাঙ্গোলিন পাচার, নেপথ্যে কোটি ডলারের অবৈধ বাজার

 প্যাঙ্গোলিন পাচার, নেপথ্যে কোটি ডলারের অবৈধ বাজার

বিলুপ্তির পথে প্রকৃতির ‘সাঁজোয়া সৈনিক’

ফরিদুল আলম:

প্রকৃতির এক অদ্ভুত ও বিস্ময়কর সৃষ্টি প্যাঙ্গোলিন বা বনরুই। দেখে মনে হতে পারে কোনো আদিম যুগের প্রাগৈতিহাসিক যোদ্ধা নিজের পিঠে শক্ত বর্ম নিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে চলেছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, এই নিরীহ প্রাণীটিই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানুষের সীমাহীন লোভ আর কুসংস্কারের বলি হয়ে আজ তারা বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে।

পাচারের শীর্ষে: নেপথ্যে কোটি ডলারের অবৈধ বাজার

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সর্বশেষ তথ্য ও বন্যপ্রাণী বাণিজ্য পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর মতে, গত দুই দশকে ১০ লাখেরও বেশি প্যাঙ্গোলিন শিকার ও পাচার করা হয়েছে। এই সংখ্যাটি বাঘ বা গণ্ডারের পাচারের তুলনায় অনেক বেশি। মাল্টি-মিলিয়ন ডলারের এই অবৈধ বাজারে প্যাঙ্গোলিন এখন সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পণ্য। মূলত এশিয়ার কিছু দেশের বাজারে এদের আঁশ ও মাংসের ব্যাপক চাহিদাই এই নিধনযজ্ঞের মূল কারণ।

কুসংস্কার বনাম বিজ্ঞান

প্যাঙ্গোলিনের প্রধান শত্রু তাদের শরীরের এই অনন্য আঁশ। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই আঁশ মূলত কেরাটিন দিয়ে তৈরি—একই উপাদান যা দিয়ে মানুষের হাতের নখ ও চুল গঠিত। আধুনিক বিজ্ঞান বারবার প্রমাণ করেছে যে এর কোনো জাদুকরী ওষুধি গুণ নেই। অথচ ঐতিহ্যগত চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করা হয় কেবল ভিত্তিহীন কুসংস্কারের ওপর নির্ভর করে। মানুষের নখের মতো এক টুকরো জড় উপাদানের জন্য একটি আস্ত প্রজাতিকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা কি আধুনিক সভ্যতার চরম নৈতিক পরাজয় নয়?

বাস্তুসংস্থানের নীরব রক্ষক

প্যাঙ্গোলিনরা বনের নীরব কারিগর। এরা প্রচুর পরিমাণে উইপোকা ও পিঁপড়া খেয়ে বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষা করে। একটি পূর্ণবয়স্ক প্যাঙ্গোলিন বছরে প্রায় ৭ কোটি কীটপতঙ্গ খেয়ে বন উজাড় হওয়া থেকে রক্ষা করে। বনের নির্জন কোণে লুকিয়ে থাকা এই লাজুক প্রাণীগুলো কারো কোনো ক্ষতি করে না। অথচ তাদের আর্তনাদ লোকচক্ষুর আড়ালেই হারিয়ে যাচ্ছে।

অস্তিত্বের লড়াইয়ে ৮ প্রজাতি

বর্তমানে বিশ্বে আট প্রজাতির প্যাঙ্গোলিন টিকে আছে, যার মধ্যে চারটি আফ্রিকায় এবং চারটি এশিয়ায়। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) এর লাল তালিকায় সবকটি প্রজাতিই এখন ‘বিপন্ন’ বা ‘মারাত্মকভাবে বিপন্ন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত। চোরাশিকারিদের থাবা থেকে বাঁচতে এরা নিজেদের গোল বলের মতো গুটিয়ে নেয়, যা তাদের রক্ষা করার বদলে শিকারিদের হাতে ধরা পড়া আরও সহজ করে দেয়।

প্রকৃতির এই বিচিত্র সৃষ্টি রক্ষা করা এখন কেবল পরিবেশবাদীদের কাজ নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত নৈতিক দায়িত্ব। কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই পাচার রোধ করা না গেলে, পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এই প্রাগৈতিহাসিক রূপের প্রাণীকে কেবল ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাবে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এই ‘সাঁজোয়া সৈনিক’দের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই প্রয়োজন।