ফিচার
সৈকত আহমেদ, নরসিংদী:
বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন ফলের রাজ্যে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে কাঁঠাল। এটি শুধু বাংলাদেশের জাতীয় ফলই নয়, গ্রামীণ জীবন, ঐতিহ্য ও পারিবারিক স্মৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রীষ্মের শুরু থেকে শরতের আগমন পর্যন্ত কাঁঠালের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে হাটে-ঘাটে, বাড়ির উঠানে কিংবা গ্রামের রাস্তার ধারে।
বছরের এই সময়টাতেই গাছে গাছে ফল ধরতে শুরু করে। কাঁঠাল এমন একটি ফল, যার প্রতিটি অংশই কাজে লাগে। এর শাঁস যেমন সুস্বাদু, তেমনি বিচি রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এমনকি কাঁঠালের খোসাও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় বহু জায়গায়।
পুষ্টিগুণে ভরপুর:
কাঁঠাল শুধু স্বাদের জন্য নয়, পুষ্টিগুণেও অনন্য। এটি শক্তি প্রদানকারী ফল। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালে রয়েছে প্রায় ৯৫ কিলোক্যালরি শক্তি, সঙ্গে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান। এতে ফাইবার থাকায় হজমে সহায়তা করে, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কাঁঠালে থাকা ভিটামিন এ চোখের জন্য উপকারী, আর পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আবার, কাঁঠালের বিচি প্রোটিনের একটি ভালো উৎস হিসেবে কাজ করে, যা মাংসের বিকল্প হিসেবেও বিবেচিত।
লোকজ সংস্কৃতিতে কাঁঠালের ভূমিকা:
বাংলার লোককথা, ছড়া, গান ও গল্পে কাঁঠালের উপস্থিতি প্রায় নিয়মিত। ‘গোশতের ঘ্রাণে হাড়ে যায়, কাঁঠালের গন্ধে মনে হয় খাইছি’—এমন লোককথা এখনো শুনতে পাওয়া যায় গ্রামের প্রবীণদের মুখে। অনেক এলাকায় কাঁঠাল কাটার সময় পরিবার-প্রতিবেশীদের ডেকে খাওয়ানো একধরনের সামাজিক রেওয়াজ।
এক সময় গ্রামে কাঁঠালকে বলা হতো ‘গরিবের পেট ভরার ফল’। কারণ, কাঁঠাল সহজলভ্য ও বড় হওয়ায় একটি ফল দিয়েই অনেক লোক খেতে পারত। এখনো এটি পল্লি অঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তায় অবদান রাখে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
বাংলাদেশে উৎপাদিত কাঁঠালের একটি বড় অংশ স্থানীয় বাজারেই বিক্রি হয়। তবে সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে প্রবাসীদের কাছে এর চাহিদা বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কাঁঠাল এখন কৃষকদের জন্য লাভজনক ফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নরসিংদী, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, দিনাজপুর, রাঙ্গামাটি ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠাল চাষ হচ্ছে। কেউ কেউ আবার কাঁঠাল দিয়ে আচার, জ্যাম কিংবা শুকনো শাঁস তৈরি করে বাড়তি আয়ের পথও খুঁজে নিচ্ছেন।
পরিবেশবান্ধব ফল:
কাঁঠাল গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং খুব বেশি যত্ন ছাড়াই ফল দেয়। এটি ভূমিক্ষয় রোধে সহায়ক এবং গ্রামীণ পরিবেশে ছায়া দেয়। গবেষকরা বলছেন, কাঁঠাল ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি সম্ভাবনাময় ফল, কারণ এটি বড় এবং বহু মানুষের আহার যোগাতে সক্ষম।
চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
তবে সমস্যা একটাই—কাঁঠাল দ্রুত পচে যায় এবং পরিবহনে বেশ সতর্কতা প্রয়োজন। অনেক সময় বাজারে পর্যাপ্ত সংরক্ষণের অভাবে এই ফল নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হিমায়িত কাঁঠালের শাঁস ও বিচি রপ্তানির জন্য আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ প্লান্ট গড়ে তুললে এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আরও বাড়ানো সম্ভব।
শেষ কথা:
কাঁঠাল আমাদের ঐতিহ্য, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটু পরিকল্পিত উদ্যোগ ও আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ফল হতে পারে দেশের গর্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস।