Home আন্তর্জাতিক ঋণ খেলাপিদের স্বর্গরাজ্য পাকিস্তান

ঋণ খেলাপিদের স্বর্গরাজ্য পাকিস্তান

বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে ভয় পায় ব্যাংকগুলো

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সাধারণত কোনো দেশের অর্থনীতির উত্থান-পতনের সঙ্গে সেই দেশের ব্যাংকিং খাতের ভাগ্যও জড়িয়ে থাকে। কিন্তু পাকিস্তানের গল্পটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশটির অর্থনীতি ধুঁকলেও ব্যাংকিং খাত তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে এই ভালো থাকার পেছনে রয়েছে এক অদ্ভুত কৌশল। পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো দেশের প্রকৃত অর্থনীতি বা বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার বদলে সরকারকে ঋণ দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

এর মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে দেশটির দুর্বল ঋণ আদায় আইন এবং অকার্যকর বিচার ব্যবস্থা, যা ঋণখেলাপিদের শাস্তির বদলে প্রকারান্তরে পুরস্কৃত করে।

কেন বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে অনীহা?
পাকিস্তানে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর, এমনকি কয়েক দশক ধরে ফেরত না দিলেও খুব একটা বিপাকে পড়তে হয় না। কারণ, আইনি প্রক্রিয়া এতোটাই দীর্ঘমেয়াদী যে তা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বিদেশি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী বলেন, “আইন প্রয়োগে দুর্বলতা, আইনি ফাঁকফোকর এবং আদালতের ধীরগতির কারণে ঋণ আদায় করা প্রায় অসম্ভব। এ কারণেই ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে, বিশেষ করে যেখানে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বেশি, সেখানে ঋণ দিতে চায় না। তারা জানে, একবার ঋণ কুঋণে (Bad Loan) পরিণত হলে তা আইনি জটিলতায় আটকে যাবে।”

তিনি আরও জানান, সরকারি ব্যাংকগুলো লোকসান সামাল দিতে পারলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সেই সক্ষমতা বা সরকারি সুরক্ষা নেই।

খেলাপি ঋণের ভয়াবহ পরিসংখ্যান
ঋণ আদায়ে আইনি দীর্ঘসূত্রতার ফলাফল পাকিস্তানের উচ্চ ‘নন-পারফর্মিং লোন’ (NPL) বা খেলাপি ঋণের হারে স্পষ্ট। বর্তমানে দেশটিতে খেলাপি ঋণের হার ৭.৪ শতাংশ, যা বৈশ্বিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি। তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ১.৫ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ১ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় যথাক্রমে ২.২৫ ও ১.৬ শতাংশ।

স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশটির ব্যাংকখাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬৪ বিলিয়ন রুপি। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (১৫৮.৩ বিলিয়ন রুপি) শীর্ষে রয়েছে। এরপরই রয়েছে ইউনাইটেড ব্যাংক এবং হাবিব ব্যাংক।

আইন আছে, প্রয়োগ নেই
২০০১ সালের আর্থিক প্রতিষ্ঠান অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঋণ আদায়ে বিশেষ ব্যাংকিং আদালত ও দ্রুত নিষ্পত্তির কথা বলা থাকলেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। একজন করপোরেট আইনজীবী জানান, আইনটি কাগজে-কলমে শক্তিশালী হলেও এর প্রয়োগ নেই।

তিনি বলেন, “ঋণগ্রহীতারা নিয়মিত আদালতের স্থগিতাদেশ (Stay Order) নিয়ে আসেন, পাল্টা মামলা করেন এবং আপিলের মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করেন। এমনকি রায়ের পরও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। পুলিশ বা প্রশাসন সাহায্য করতে চায় না, আর ঋণগ্রহীতারাও বন্ধকী সম্পদ হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেন।”

শ্রীলঙ্কার মডেল ও ব্যাংকারদের দাবি
ঋণ আদায় ব্যবস্থা সংস্কারে পাকিস্তানের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার ‘প্যারাট এক্সিকিউশন’ (Parate Execution) মডেল চালুর দাবি জানিয়ে আসছে। শ্রীলঙ্কায় এই পদ্ধতির ফলে ব্যাংকগুলো আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করতে পারে। ঋণখেলাপির ১৪ দিনের মধ্যে টাকা শোধ না করলে ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে টাকা আদায় করে নেয়। এতে সেখানে ঋণ আদায় প্রক্রিয়ায় গতি এসেছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তানে দক্ষ বিচারকের অভাব এবং উচ্চ আদালতে মামলার পাহাড় জমে থাকায় ঋণ আদায় প্রক্রিয়া অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব
ঋণ আদায়ে এই আইনি কাঠামোর দুর্বলতার চড়া মাশুল গুনতে হচ্ছে পাকিস্তানের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) এবং কৃষকদের। ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ দিতে চায় না। এমনকি গৃহঋণ বা মর্টগেজ মার্কেটও বিকশিত হতে পারছে না, কারণ খেলাপি হলে বাড়ি বা জমি দখল নেওয়ার নিশ্চয়তা নেই।

ফলস্বরূপ, ব্যাংকগুলো নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সরকারকেই বেছে নিচ্ছে, আর দেশের উৎপাদনশীল খাত ও সাধারণ মানুষ ঋণের অভাবে ধুঁকছে।