তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের পরিবেশ যখন গভীর সংকটে, তখন ২০২৪-২৫ সালে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ পরিবেশ সুশাসনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। পলিথিন নিষিদ্ধকরণ, নদী উদ্ধার এবং শব্দ ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি দেশজুড়ে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। ২০২৫ সাল জুড়ে নেওয়া ধারাবাহিক উদ্যোগগুলো পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনিক দৃঢ়তার নজির স্থাপন করেছে।
২০২৫ সালের অন্যতম আলোচিত সাফল্য ছিল নিষিদ্ধ পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী কঠোর অভিযান। ১ নভেম্বর ২০২৪ থেকে কাঁচাবাজারে এবং ৩ নভেম্বর থেকে সুপারশপগুলোতে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে চিরুনি অভিযান শুরু হয়। এই কার্যক্রম ২০২৫ সালজুড়ে অব্যাহত থাকে। শত শত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে জরিমানা আদায়ের পাশাপাশি অবৈধ পলিথিন কারখানা সিলগালা করা হয়। একই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ সচিবালয়কে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক মুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হয়, যা সরকারি দপ্তরগুলোর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নদী ও জলাভূমি রক্ষায় সরকার একাধিক কাঠামোগত উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সব নদীর জন্য হেলথ কার্ড চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নদীর স্বাস্থ্যের তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি সংরক্ষণ অধ্যাদেশ ২০২৫ এর নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। এর ফলে হাওর এলাকায় অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আইনি ভিত্তি শক্ত হয়েছে। রাজধানীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীসহ ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ খাল উদ্ধারে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
শব্দ ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণেও ২০২৫ সালে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকাকে হর্নমুক্ত ঘোষণার পর জানুয়ারি থেকে ঢাকার ১০টি গুরুত্বপূর্ণ সড়ককে সাইলেন্স জোন হিসেবে কার্যকর করা হয়। বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানো হয়। ঢাকার আশপাশে কয়েকশ অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট ব্যবহারে নীতিগত জোর দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান জোরালো হয়েছে। কপ২৯সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিলের স্বচ্ছতা ও ন্যায্য বণ্টনের দাবি তুলে ধরে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ রক্ষায় পর্যটন নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর নীতিমালাও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদীদের প্রশংসা পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উদ্যোগ সাময়িক সংস্কার নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ৩ হাজার ৫৬৯ জন পরিবেশ কর্মকর্তা এবং বিসিএস পরিবেশ ও বন ক্যাডার চালুর প্রস্তাব খাতটিকে পেশাদারিত্বের নতুন স্তরে নিয়ে যাবে। নদী, বন ও পাহাড় রক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগের ফল ২০২৬ সালে আরও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সামগ্রিকভাবে ২০২৫ সালকে পরিবেশগত সুশাসনের বছর হিসেবে দেখছেন নীতিনির্ধারক ও পরিবেশবিদরা। জনসম্পৃক্ততা ও প্রশাসনিক দৃঢ়তার সমন্বয়ে নেওয়া পদক্ষেপগুলো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পরিবেশের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করার পথ দেখিয়েছে। সবুজ ও বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ার এই যাত্রায় সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের।










