Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য গহিরা গ্রামের ভোর: মা দেখেছিলেন বিপ্লবী কল্পনা দত্তকে

গহিরা গ্রামের ভোর: মা দেখেছিলেন বিপ্লবী কল্পনা দত্তকে

স্বাধীনতা সংগ্রামী কল্পনা দত্ত (যোশী)

কামরুল ইসলাম:

১৯৩৩ সালের এক ভোরে ব্রিটিশ পুলিশের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ঘুম ভাঙে গহিরা গ্রামের মানুষের। শিশুমনেও সেই শব্দ থেকে যায় আজীবনের জন্য। আমার মা ছায়েরা খাতুন, তখন বয়স ছয় কিংবা সাত। খুব সাধারণ একজন গ্রামীণ নারী। অক্ষরজ্ঞান বলতে গেলে কোনো রকমে চিঠি লিখতে পারা এবং পড়তে পারার বেশি কিছুই ছিল না, তবু তার স্মৃতিতে ছিল এক অমলিন ছবি বিপ্লবী কল্পনা দত্তকে দেখে ফেলার বিস্ময়। কিন্তু কল্পনা দত্তকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ ছিল অসম্ভব স্পষ্ট। তাঁর চোখে কল্পনা ছিলেন এক সাহসিনী, এক লড়াকু রমনী। কল্পনার মুখের রেখায় ভয় নয়, ছিল সংগ্রামের দীপ্তি।

চট্টগ্রামের আনোয়ারার গহিরা গ্রামের উঠান মাঝির বাড়ি, যেখানে মা তখন ছিলেন। তাদের উঠোন থেকে আধা কিলোমিটার দূরে মাইল্যার বাড়ি (তালুকদার বাড়ি) ছিল সেই আশ্রয়স্থল। সেখানে ধরা পড়েন কল্পনা দত্ত। মা বলতেন, সেদিন সারারাত ধরে পুলিশ ও কল্পনার মধ্যে চলে গুলির লড়াই। দোতলা মাটির বাড়িটি যেন যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিল। নারী হয়ে হাতে বন্দুক-এই ছবি মা কোনোদিন ভুলতে পারেননি।

ভোররাতে, গুলি ফুরিয়ে গেলে কল্পনা দত্ত আত্মসমর্পণ করেন। সকালে যখন তাঁকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল উঠান মাঝির বাড়ির একেবারে কাছে দিয়ে, তখনই দেখেন আমার মা। তাঁর বর্ণনায় কল্পনা দত্তের চওড়া বুক, দীর্ঘ শরীর, কাঁধে শাড়ি জড়ানো। কল্পনার মুখে ছিল না একটুও ভয়, ছিল একরকম দৃঢ়তা, যেন তিনি জানেন ইতিহাস তাঁকে ভুলবে না।

গহিরা গ্রাম। সংগৃহীত ছবি

এই বর্ণনা মিলে যায় কল্পনা দত্তের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ Chittagong Armoury Raiders’ Reminiscences–এর সঙ্গে। সেখানেই তিনি লেখেন:

এই তথ্যটি তার আত্মজীবনী “চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা” গ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে, যেখানে তিনি লিখেছেন: “On the 19th May, while in a shelter at the village of Gahira, Anwara P. S., early in the morning we found that we had been surrounded by the police. For sometime, shots were exchanged. The owner of the house, Puma Talukdar, who had given us shelter was instantaneously killed by police firing. In my own presence, his younger brother Nisi Talukdar was wounded by a police bullet passing right through his heart. And with them was killed another young comrade, 16-year old Manoranjan Das. Tarakeswar Dastidar and myself were captured there. (Here too, the lady of the house was given 4 years’ imprisonment.)”

(১৯ মে ভোরে আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামে পুলিশের ঘেরাও পড়ে। কিছুক্ষণ গুলি বিনিময়ের পর তালুকদার পরিবারের সদস্য পুণা তালুকদার পুলিশের গুলিতে নিহত হন, এবং তার ভাই নিসি তালুকদার গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সঙ্গে নিহত হন আমাদের কমরেড মনোরঞ্জন দাস। আমাকে ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে সেখানেই গ্রেপ্তার করা হয়। বাড়ির গৃহিণীকেও চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।)

মায়ের স্মৃতিতে এটাও ছিল মাইল্যার বাড়ির প্রতিটি সদস্য, এমনকি শিশুরাও ছাড় পাননি। ইংরেজ শাসকের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পায়নি কল্পনাকে আশ্রয় দেওয়া সেই পরিবারটি।

আজ মা নেই, কিন্তু তাঁর মুখে শোনা সেই গল্প আজও কাঁপিয়ে তোলে হৃদয়। এক গ্রামীণ নারীর চোখে দেখা বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে ইতিহাসের জীবন্ত অধ্যায়। শিক্ষা ছিল না, কিন্তু মনে ছিল একটি সাহসী নারীর দৃপ্ত পদচারণার ছবি, যে ছবি ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিতে লেখা হয়নি, কিন্তু মায়ের হৃদয়ে গেঁথে ছিল আজীবন।

কল্পনা দত্ত ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম হয়। তার বাবা বিনোদ বিহারী দত্তগুপ্ত একজন সরকারি কর্মচারী। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রামে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরতিনি কলকাতায় যান এবং বিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য বেথুন কলেজে যোগদান করেন। সেখানে আধা-বিপ্লবী সংগঠন ছাত্রী সংঘে (মহিলা ছাত্র সমিতি) যোগদান করেন। সক্রিয় সদস্য ছিলেন বীণা দাস এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ।