বিজনেসটুড২৪ প্রতিনিধি, বান্দরবান: বান্দরবানের আলীকদমে ট্র্যাভেল অভিযানে অংশ নিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন শেখ জুবাইরুল ইসলাম ও স্মৃতি আকতার নামের দুই পর্যটক। নিখোঁজ রয়েছেন সহ-আয়োজক হাসান। অভিযানের নেতৃত্বে থাকা অনলাইনভিত্তিক ট্যুর এক্সপার্ট গ্রুপের অ্যাডমিন বর্ষা ইসলাম বৃষ্টিকে ইতোমধ্যেই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তদন্তকারীরা বলছেন, এই ঘটনায় ট্র্যাভেল উদ্যোক্তাদের দায়িত্বহীনতা ও দুর্বল প্রস্তুতির চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ফেসবুক গ্রুপ “ট্যুর এক্সপার্ট”এর এডমিন ও যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার জগদীশপুর ইউপির আড়পাড়া, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রবিউল ইসলামের কন্যা বর্ষা ইসলাম বৃষ্টি। শনিবার (১৪ জুন) বেলা ১১টার পর আলীকদম থেকে বর্ষা ইসলাম বৃষ্টিকে গ্রেপ্তার করা হয়। বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পুপার জিনিয়া চাকমা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।অভিযুক্তকে কোর্টে চালান করা হয়েছে বলে জানান আলীকদম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির্জা জহির উদ্দিন।
বিপদের শুরু তৈন খাল:
১১ জুন ভোরে ঢাকা থেকে রওনা দেয় ৩৩ সদস্যের পর্যটক দলটি। তাদের লক্ষ্য ছিল থানচির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল পেরিয়ে ক্রিসতং চূড়ায় পৌঁছানো। শুরু থেকেই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ছিল, তবে ট্রিপ বাতিল বা পেছানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন সদস্য।
এক পর্যায়ে তৈন খাল পার হওয়ার সময় স্রোতের তোড়ে ভেসে যায় কয়েকজন। দলটি তখন দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। যারা পেছনে পড়েছিলেন, তাদের সাহায্য করার মতো পর্যাপ্ত গাইড বা উদ্ধারকৌশল ছিল না।
প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য:
প্রত্যক্ষদর্শী সদস্য মারুফ হাসান বলেন, “আমরা বারবার বর্ষা আপুকে অনুরোধ করেছিলাম যেন তৈরি না হলে এই পথ না ধরা হয়। কিন্তু তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেন যে গাইড আছে, কিছু হবে না। অথচ তৈন খাল পার হওয়ার সময় দেখলাম গাইডরাও দ্বিধায় পড়ে গেছেন। যারা ডুবে গেছেন, তাদের সাহায্য করার মতো কোনো প্রস্তুতি আমাদের ছিল না।”
নিহতদের পরিবারের অভিযোগ:
স্মৃতি আকতারের বাবা মো. আবদুল জলিল বলেন, “আমার মেয়ে পাহাড় ভালোবাসত। সে বিশ্বাস করেছিল যে এই ট্র্যাভেল গ্রুপ তাকে নিরাপদে রাখবে। কিন্তু বর্ষা কোনো অনুমতি নেয়নি, কোনো সিকিউরিটি প্ল্যান ছিল না। শুধু ব্যবসায়িক লাভের জন্য মেয়ে হারালাম। আমরা বিচার চাই।”
তিনি থানায় দায়িত্বহীনতা ও প্রতারণার অভিযোগে মামলা করলে বর্ষাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রশাসনের তদন্ত:
বান্দরবানের পুলিশ সুপার জানান, ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ, অভিযানের প্রস্তুতি পরিকল্পনা ও আবহাওয়ার সতর্কতা উপেক্ষার বিষয়গুলো তদন্তে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনও ট্র্যাভেল গ্রুপগুলোর কার্যক্রমে নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পুলিশ সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে বর্ষা ইসলাম পর্যটকদের বিপজ্জনক অভিযানে নিয়ে যাওয়ার আগে কোনো সরকারি অনুমতি নেননি, যা নিয়ম অনুযায়ী অপরাধ।
গ্রুপ ট্র্যাভেলের খোলসের ভেতর:
বাংলাদেশে ফেসবুকভিত্তিক ট্র্যাভেল গ্রুপের সংখ্যা বাড়লেও অধিকাংশ গ্রুপই নিবন্ধিত নয়। নেই কোনো নীতিমালা, প্রশিক্ষিত গাইড, কিংবা দুর্ঘটনা-পরবর্তী সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা। অনেকেই ব্যবসার সুযোগ দেখে ‘অ্যাডমিন’ পরিচয়ে লোকজনকে নিয়ে যান বিপজ্জনক অভিযানে।
বাংলাদেশ অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের একজন সদস্য বলেন, “দুর্গম পাহাড়ি অভিযানে যাওয়ার আগে আবহাওয়ার সতর্কতা, রুট পারমিশন, ফার্স্ট এইড, অভিজ্ঞ গাইড ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ বাধ্যতামূলক। এসব নিয়ম না মানলে, এই রকম মৃত্যু ঘটতেই থাকবে।”
নতুন নীতিমালা আসছে?
পর্যটন বোর্ড জানিয়েছে, এই ঘটনা পর দেশের ট্র্যাভেল গ্রুপগুলোর কার্যক্রম নিয়মবদ্ধ করতে প্রাথমিক আলোচনায় বসা হয়েছে। দুর্গম এলাকায় ভ্রমণের জন্য পর্যাপ্ত অনুমতি, লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো অভিযানে না যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।