পর্ব-৩:
কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: কারখানার কড়চায় গড়া শুকনো চা-পাতা যখন ব্যাগ ভরে রওনা দেয়, তখন তা দেখতে নিরীহ, ধূসর, প্রায় অব্যক্ত। অথচ তার পেছনে লুকিয়ে থাকে বহুস্তরীয় এক শৃঙ্খল। সেই পরবর্তী স্তর হলো ‘ওয়্যারহাউস’, যা চায়ের গন্তব্য নয়, বরং তার গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণের নীরব রঙ্গমঞ্চ।
চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ চা বোর্ড অনুমোদিত ওয়্যারহাউসগুলোতে প্রস্তুত চা আসে গোপন এক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। কাঠের ট্রলিতে ঠেলাজাওয়া ব্যাগগুলোর গায়ে ছাপানো থাকে ব্যাচ নম্বর, উৎপাদনের তারিখ, গ্রেডিং কোড। এই ব্যাগগুলি কিন্তু সরাসরি নিলামকেন্দ্রে যায় না, যেমনটা অনেকেই ভুলভাবে মনে করেন।
প্রথমেই এই ব্যাগগুলি প্রবেশ করে কড়া নিয়ন্ত্রণাধীন ওয়্যারহাউসে। এখানে সরকারি প্রতিনিধি, ব্রোকার হাউজের টেস্টার এবং গুদাম ব্যবস্থাপক একসঙ্গে মিলিয়ে দেখেন প্রতিটি ব্যাগের অবস্থা। প্রতিটি ব্যাগ খুলে নেওয়া হয় নমুনা, যা পরে পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট ব্রোকার হাউজে।
নমুনা যাচাই প্রক্রিয়া:
ব্রোকার হাউজে সেই নমুনা পৌঁছালে শুরু হয় চা-পরীক্ষকের আসল কাজ। আর তা হলো: চা-রঙ, ঘ্রাণ, শুষ্কতা ও স্বাদের বিশ্লেষণ। পরীক্ষক প্রতিটি নমুনা চুমুক দিয়ে বোঝেন, ব্যাচটি আদৌ বাজারে টিকবে কিনা। কোনো ব্যাচে অমসৃণতা ধরা পড়লে, তার নিলামমূল্য পড়ে যায় বা বাতিল হয় সম্পূর্ণ।
ওয়্যারহাউসের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ:
চা সংরক্ষণের উপযোগী পরিবেশ বজায় রাখতে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং আলো বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। কিছু ওয়্যারহাউসে ২৪ ঘণ্টার তাপমাত্রা ২০–২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা হয়, আর্দ্রতা ৬৫ শতাংশের বেশি যেন না হয় তা নিশ্চিত করা হয়। কারণ সামান্য ভেজাভাবও পুরো ব্যাচ নষ্ট করে দিতে পারে।
নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি:
প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে চা ব্রোকাররা সরকারি প্রতিনিধির সঙ্গে ওয়্যারহাউসে যান ব্যাগ গণনার জন্য। রেজিস্টারে সই, নমুনা মিলিয়ে দেখা ও গুদাম রক্ষণাবেক্ষণের খতিয়ান সবকিছু হয় এক নিখুঁত সমন্বয়ে। এই সময় কিছু উৎপাদক সংস্থা নিজেরাই নিরীক্ষক পাঠায় গুণগত মান নিশ্চিতে।
ওয়্যারহাউসের প্রবেশপথে থাকে নিরাপত্তা স্ক্যানার, আইডি কার্ডভিত্তিক প্রবেশাধিকার, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ও দৈনিক হাজিরা খাতা। একটি ব্যাগ যেটি আগামী সপ্তাহে বিক্রি হবে ৪০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা দরে, এখন সেটা কেবল এক থলি ধুলোময় পাতা মাত্র, তবু সেটির নিরাপত্তায় ছাড় নেই।
নিলামের জন্য প্রস্তুতি:
ওয়্যারহাউস থেকে ব্রোকার হাউজের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর তৈরি হয় ‘নিলাম ক্যাটালগ’। এতে ব্যাচ নম্বর, গ্রেড, পরিমাণ ও গুণমান অনুযায়ী মূল্য প্রস্তাব রাখা হয়। এই ক্যাটালগই পাঠানো হয় চা নিলামকেন্দ্রে।
চট্টগ্রামে প্রতি মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় ‘চা নিলাম’। এই আয়োজনের মূল নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ চা বোর্ড। আর নিলামের পর্দার আড়ালে যারা সক্রিয় তারা হল ব্রোকার হাউজ, যারা ওয়্যারহাউস থেকে নমুনা নিয়ে মূল্যনির্ধারণ করে এবং ক্রেতার কাছে তা উপস্থাপন করে।
একটি চা ব্যাগের ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে এই নীরব পরিসরে:
কারখানার ধাতব শব্দের জগৎ থেকে আলাদা এই ওয়্যারহাউস জগতে শাসন করে ঘ্রাণ, ওজন আর শুষ্কতার ভাষা। এখানে চা কথা বলে না, তবু তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হয় মৌন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে।
📢 CTA (পাঠকের জন্য আহ্বান):
আপনি কখনো ভেবেছেন, আপনার প্রতিদিনের চায়ের কাপে ঢুকে আছে এইরকম একটি দীর্ঘ যাত্রাপথ? আপনার এলাকায় এমন কোনো চা ওয়্যারহাউস বা নিলামকেন্দ্র রয়েছে কি? জানাতে পারেন আমাদের বিজনেসটুডে২৪.কম-এর পাঠক মতামত সেকশনে।