ফিচার ডেস্ক:
আজকের আধুনিক রেলব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল প্রায় দুই শতাব্দী আগে, ইংল্যান্ডের এক শান্ত শহর ডারলিংটনে। বিশ্বের প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন, যেটি প্রকৃত অর্থেই ‘রেলওয়ের যুগ’ সূচনা করে, সেটি চালু হয়েছিল ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। এই দিনটি ইতিহাসে অমর হয়ে আছে, প্রযুক্তি, শিল্পায়ন ও গণপরিবহনের নতুন অধ্যায়ের সূচক হিসেবে।
যাত্রার সূচনা : স্টকটন থেকে ডারলিংটন:
স্টকটন ও ডারলিংটন রেলওয়ে ছিল প্রথম পাবলিক রেললাইন, যেখানে বাষ্পচালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করে মানুষ পরিবহন শুরু হয়। এই রেললাইনটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল কয়লা পরিবহন। কিন্তু এর উদ্বোধনী দিনে প্রায় ৬০০ যাত্রী নিয়ে বাষ্পচালিত একটি ট্রেন যখন চলতে শুরু করে, তখনই বদলে যায় ইতিহাসের গতি।
এই ট্রেনটির নাম ছিল “লোকোমোশন নম্বর ১” এবং এটি চালিয়েছিলেন একজন যুগান্তকারী প্রকৌশলী জর্জ স্টিভেনসন। তিনি ছিলেন রেল পরিবহনের জনক হিসেবে পরিচিত, যিনি কেবল ইঞ্জিন নয়, রেললাইন নির্মাণের প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করেন।
বাষ্পের গর্জনে প্রযুক্তির জাগরণ:
সেই সময় ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ১৫ মাইল (প্রায় ২৪ কিলোমিটার)। আজকে শুনতে মৃদু মনে হলেও তখনকার জন্য এটি ছিল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির চেয়ে বহুগুণ দ্রুতগতিতে ছুটে চলা এই যন্ত্রমানব যেন শিল্পবিপ্লবের নতুন প্রতীক হয়ে ওঠে।
এই যাত্রায় লোকোমোশন ইঞ্জিনে মোট ৩৩টি ওয়াগন যুক্ত ছিল। এর মধ্যে কয়লা, যাত্রী ও পণ্য বহনের পৃথক বগি ছিল। বিশাল কোলাহল, ধোঁয়ার মেঘ আর রেল লাইনের কম্পন—সব মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করে সেই যাত্রা।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব:
ডারলিংটনের এই উদ্যোগ শুধু একটিবারের প্রদর্শনী ছিল না; এটি ছিল ভবিষ্যতের পৃথিবীর দিকে এক দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। শিল্প বিপ্লবের সময় কয়লার পরিবহন এবং শ্রমিকদের যাতায়াত ছিল চরম দুশ্চিন্তার বিষয়। রেলওয়ের আবিষ্কার এই সংকট নিরসনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
পরবর্তী দুই দশকে ব্রিটেনজুড়ে রেলপথ ছড়িয়ে পড়ে। কেবল ইংল্যান্ড নয়, এরপর ইউরোপ, আমেরিকা, ভারতসহ উপনিবেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে রেল যোগাযোগ। মানুষের জীবনযাত্রা ও সময়ের ধরণ বদলে যেতে থাকে। সময় বাঁচে, ব্যবসা বাড়ে, শহর ও গ্রাম এক সুতোয় গাঁথা পড়ে রেললাইন দিয়ে।
জর্জ স্টিভেনসনের জীবনী
জর্জ স্টিভেনসন জন্মগ্রহণ করেন ১৭৮১ সালের ৯ জুন, ইংল্যান্ডের নর্থইস্ট শহরের ওয়াইলাম গ্রামে, এক দরিদ্র খনি শ্রমিকের পরিবারে। ছোটবেলায় দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি, কাজ করতে হতো খনির খুঁটি মেরামতকারী হিসেবে। কিন্তু তাঁর ছিল অদম্য কৌতূহল ও যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার আকাঙ্ক্ষা।
নিজ উদ্যোগে রাতে প্রাইভেট ক্লাসে গিয়ে পড়ালেখা শিখেন তিনি। এর পর খনি অঞ্চলে ইঞ্জিন মেরামতের কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন।
১৮১৪ সালে তিনি প্রথম সফলভাবে একটি বাষ্পচালিত ইঞ্জিন তৈরি করেন, যা খনির মালামাল টানার কাজে ব্যবহার হয়। পরে ১৮২৫ সালে স্টকটন-ডারলিংটন রেলওয়ের জন্য তৈরি করেন “লোকোমোশন নম্বর ১”—বিশ্বের প্রথম যাত্রীবাহী বাষ্প ট্রেন।
স্টিভেনসন শুধু ইঞ্জিন আবিষ্কার করেননি, বরং সম্পূর্ণ রেলপথ পরিকল্পনা, রেল ইঞ্জিনের জন্য উপযুক্ত ঢাল-উতরাই, রেললাইন বসানোর কৌশল সবই তিনিই উদ্ভাবন করেন। এই সব কারণে তিনি ইতিহাসে “ফাদার অব রেলওয়ে” নামে খ্যাত হন।
১৮৪৮ সালে ৬৭ বছর বয়সে জর্জ স্টিভেনসনের মৃত্যু হয়। আজও তাঁর নাম প্রযুক্তি, অধ্যবসায় ও উদ্ভাবনের ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লেখা আছে।
ইতিহাসের স্মারক : ডারলিংটন আজও অমর
বর্তমানে ইংল্যান্ডের ডারলিংটন শহরে রয়েছে একটি রেলওয়ে মিউজিয়াম—“Head of Steam”—যেখানে সংরক্ষিত আছে লোকোমোশন নম্বর ১-এর অংশবিশেষ। প্রতি বছর হাজারো পর্যটক এই মিউজিয়ামে এসে দাঁড়িয়ে যান ইতিহাসের সেই প্রান্তে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল আজকের পৃথিবীর যোগাযোগ প্রযুক্তি।
শেষ কথা:
ডারলিংটন ছিল রেলওয়ের সূতিকাগার। সেখান থেকেই মানুষ প্রথম বুঝতে পারে দূরত্বকে জয় করার স্বপ্ন একদিন বাস্তবও হতে পারে। এই একটি ট্রেনের যাত্রাই বদলে দেয় ইতিহাসের গতিপথ, বদলে দেয় সভ্যতার গতি। আর সেই ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন এক দরিদ্র খনি শ্রমিকের ছেলে জর্জ স্টিভেনসন।