এক অন্তহীন দুর্বার যৌবনের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যৌবনের নিরুদ্ধার উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনা, বেহিসেবী রোমান্স ও বল্গাহীন আবেগ, ইউটোপিয়ান স্বপ্ন ও দুঃসাহসিক আত্মসমর্পণ তাঁর কবিতার প্রতিটি অক্ষর ও যতিচিহ্নে মুদ্রিত হয়ে আছে। অক্লেশে তিনি উচ্চারণ করতে পারেন : “আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না
মৃত্যু হয় না –
কেননা আমি অন্যরকম ভালোবাসার হিরের গয়না
শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম।“
বাংলা কবিতার সংসারে সুনীল আজও আত্মহারা প্রেমের কবি। গতানুগতিক চাল-ডাল-নুনের সংসারে ছাপোষা মানুষের কোনও তৃতীয় নয়ন থাকে না। কিন্তু প্রেমিকদের থাকে সেই দুর্লভ দিব্যদৃষ্টি। প্রেম সত্যিই এক ব্যাখ্যাতীত ফেনোমেনোলজি। তবু তার সন্ধানেই কেটে যায় জীবনের মহার্ঘ প্রহর। তাই কবি অনায়াসে বলতে পারেন—
“ভালবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি
দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮ নীলপদ্ম…”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এইসব অবিস্মরণীয় পঙক্তি আজও পাঠকের মুখে মুখে ফেরে। বাস্তবের যে নারীকে আমরা ভালোবাসি, একসময় তার রক্তমাংসের অস্তিত্ব গৌণ হয়ে যায়। বড় হয়ে ওঠে তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা মন্ময় ফ্যান্টাসি ও স্বপ্নময়তা। রোবেয়ার দেনোর কবিতার অনুবাদ করতে গিয়েও সুনীল লিখেছেন সেই মন্ময় অনুভবের কথা:
“আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্ন দেখেছি যে তুমি
তোমার বাস্তবতা হারিয়ে ফেলেছ…
আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্ন দেখেছি যে হয়তো
আমার পক্ষে আর জাগাই সম্ভব হবে না।”

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার (মাদারিপুর) মাইজপাড়া (মাঠিয়ার পাড়া) গ্রামে। দিনটা ছিল ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪, বুধবার। বাংলা সাহিত্যের পটভূমিতে তিনি একাই একটা প্রতিষ্ঠান। একাধারে কবি, কথাশিল্পী, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাটককার, শিশুসাহিত্য ও ভ্রমণকাহিনির স্রষ্টা। শোনা যায় অক্ষর-সংখ্যার বিচারে না কি রবীন্দ্রনাথকেও অতিক্রম করে গেছেন তিনি। বইয়ের সংখ্যা সাড়ে তিনশোর বেশি। ছদ্মনাম— নীললোহিত, নীল উপাধ্যায়, সনাতন পাঠক। কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদক। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দুবার। ১৯৮৫ তে ‘সেই সময়’ (দ্বিতীয় খণ্ড) উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ভারত সরকারের দেওয়া সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক আশ্চর্য সৃষ্টি নীললোহিত। সে এক চিরসবুজ মনের তরুণ। যার বয়স কখনও ২৭ এর বেশি হয় না। প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তার স্বপ্ন ও কল্পনার জগৎ মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বকে অগ্রাহ্য করে আবিষ্কার করেছে এক দিকশূন্যপুর। সেই ইউটোপিয়ান জগৎ আমাদের চিরকাল হাতছানি দিয়ে ডাকে। কিন্তু খুচরো পয়সার হিসেব করতে করতে সেই স্বর্গটা আমাদের আর দেখা হয় না। ফলত দিকশূন্যপুর আমাদের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে বেঁচে থাকে। আমাদের সেই অপ্রাপ্তিতে ভরা মুখগুলোকে কল্পনায় দেখেই কি সুনীল লিখেছিলেন—
“যারা জীবনে কখনো দিকশূন্যপুরে যায়নি, কিংবা সে-জায়গাটার নামও শোনেনি, তারা বুঝতে পারবে না তারা কী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার অস্তিত্বই জানা নেই, তাকে না-পাওয়ার তো কোনো দুঃখ থাকে না। কিন্তু যারা দিকশূন্যপুরে একবার গেছে, অথচ বারবার ফিরে যেতে পারেনি, তাদের অতৃপ্তির শেষ নেই। আমি মাঝে মাঝে সেই জায়গাটার কথা ভাবি, কিন্তু আমারও যাওয়া হয়ে ওঠে না। কেউ আমাকে ডেকে নিয়ে যায় দক্ষিণে, কেউ উত্তরে।”
ডাল্টনগঞ্জ স্টেশনে এক শীতের রাতে খিদেয় ছটফট করতে করতে লেখা একটি কবিতা পড়েই দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পরিবারের একটি সুন্দরী তরুণী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রেমে ডুবে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন : “ভ্রূ-পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে/ সুগন্ধের সঙ্গ পাবো দ্বিপ্রহরের বিজন ছায়ায়/আহা কী শীতল স্পর্শ হৃদয় ললাটে, আহা চন্দন, চন্দন/ দৃষ্টিতে কি শান্তি দিলে, চন্দন, চন্দন/… ক্ষণিক ললাট ছুঁয়ে উপহার দাও সেই অলৌকিক ক্ষণ/ তুমি কি অমল-তরু, স্নিগ্ধজ্যোতি, চন্দন, চন্দন…— পড়ে আমার তো তখন পাগল-পাগল অবস্থা। মনে হয়েছিল এ আমার জন্যই লেখা, গভীর গভীরতম বনে আমাকেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইছে লোকটা। সেই লোকটাই আমার কাছে নীললোহিত, যার সঙ্গে আমি চাইলে গাছতলাতেও থাকতে পারতাম।”

খ্যাতির সহচর হল নিন্দা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবাদপ্রতিম খ্যাতির সঙ্গে দুর্নামও কম ছিল না। তিনি অনাচারী, মদ্যপ, রমণীমোহন, স্তাবক-পরিবেষ্টিত, অগভীর সাহিত্যস্রষ্টা, অযোগ্যকে অন্যায়ভাবে সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত… আরও নানা দুর্নাম তাঁকে ঘিরে ছিল আজীবন। এমন কী মৃত্যুর আগে তসলিমা নাসরিনও তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছিলেন। মৃত্যুর পরেও তার বিরাম নেই। স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন :
‘কোনও কোনও লেখক যেন এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে লোকটা শুধু মদ খেত আর প্রেম করত। একটা মাতাল প্রেমিক গোছের স্টিরিওটাইপ লক্ষ করেছি। আমার মনে হয়েছে এটাই কি মেন জিনিস ছিল ওর? হ্যাঁ জীবনে হয়তো দু’টো দিক ছিল ওর। কিন্তু সুনীল তো এক নানান ডায়ামেনশনের মানুষ।… কেউ কি জানতে চেয়েছে এই তথাকথিত প্রেমিক তকমা দেওয়া মানুষটার আড়ালে কী অসম্ভব ডিসিপ্লিনড লোক লুকিয়ে ছিল? কী অসম্ভব পরিশ্রম ও লেখার জন্য করেছে! কী সাঙ্ঘাতিক খাটনি ও খেটেছে, কাছের লোকরাই শুধু জানে! শান্তিনিকেতনে বসে আমরা, একবার লোডশেডিং হয়ে গেছে, কুলকুল করে ঘামছি, তার মধ্যে সুনীল লিখে যাচ্ছে। আমি একবার বললাম বন্ধ করো না। ও বলল, না স্বাতী আমার লেখা শেষ করতেই হবে।’

কিন্তু সুনীল শুধুই কি প্রেমের কবি? যৌবনের প্রধান দুটি ধর্ম হল প্রেম ও বিদ্রোহ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাও নিছক প্রেম আর আত্মখননেই সমাপ্ত হয়নি। বারংবার তাঁর কবিতায় শোনা গেছে সামাজিক ও রাজনৈতিক শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্তরিক ক্ষোভ আর জেহাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্পেনের মুক্তিযুদ্ধ, বলিভিয়ার সংগ্রাম, নকশাল বিদ্রোহ তাঁর কবিতায় ফিরে এসেছে বার বার :
“… চাইনি শ্মশান-শান্তি,
চাইনি পিচ্ছিল গলিঘুঁজি…
চাইনি অস্ত্রের রোষ,
শত্রু ভুলে নেশাগ্রস্ত মারণ উল্লাস
বিবেকের ঘরে চুরি, স্বপ্নের নতুন দিন ধুলোয় বিলীন
চতুর্দিকে রক্ত, শুধু রক্ত,
আমারই বন্ধু ও ভাই ছিন্নভিন্ন
এতে কার জয়?
রক্তমাখা নোংরা এই সিঁড়ি দিয়ে আমি কোনো স্বর্গেও যাবো না।“
তাঁর মরমি দৃষ্টিতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, সূর্যসেনের ফাঁসি, দীনেশ গুপ্তের মৃত্যু আর নকশাল নেতা কানু সন্তোষ অসীমদের লড়াই একসূত্রে মিশে যায়, যখন তিনি লেখেন’—
“কারাগারের ভিতরে পড়েছিল জ্যোৎস্না
বাইরে হাওয়া, বিষম হাওয়া, সেই হাওয়ায়
নশ্বরতার গন্ধ
তবু ফাঁসির আগে দীনেশ গুপ্ত চিঠি লিখেছিল
তার বউদিকে :
“আমি অমর, আমাকে মারিবার সাধ্য কাহারো নাই।”…
লোহার শিকের ওপর হাত
তিনি তাকিয়ে আছেন অন্ধকারের দিকে
দৃষ্টি ভেদ করে যায় দেয়াল, অন্ধকারও বাঙ্ময় হয়
সূর্য সেন পাঠালেন তাঁর শেষ বাণী :
‘আমি তোমাদের জন্য কী রেখে গেলাম?
শুধু একটি মাত্র জিনিস,
আমার স্বপ্ন—
একটি সোনালি স্বপ্ন
এক শুভ মুহূর্তে আমি প্রথম এই স্বপ্ন দেখেছিলাম!’
১৯৩৬ সালে স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কবি ও নাটককার ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা তখন তাঁর নিজগৃহ ‘কায়েহোনেস দে গারসিয়া’তে অবস্থান করছিলেন। ফ্রাঙ্কোর সৈন্যরা তাঁকে তুলে নিয়ে যায় এবং বন্দি করে রাখে। ১৯ আগস্ট ঘাতকেরা তাঁকে কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর লাশ গুম করে ফেলা হয়। এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি তাঁর মৃতদেহের কী গতি হয়েছিল। তাঁর বই নিষিদ্ধ করা হয় এবং পোড়ানো হয়। ক্ষমতাবান অপশক্তি ভয় পেয়েছিল তাঁর বৈপ্লবিক আদর্শকে, তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কবির মৃত্যু : লোরকা স্মরণে’ কবিতায় ফুটে উঠেছে সেই বিপ্লবী কবির জন্য প্রগাঢ় শ্রদ্ধা’—
“প্রথম গুলিটি তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল-
যেমন যায়,
কবি নিঃশব্দে হাসলেন
দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল
কবি তবু অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে
তৃতীয় গুলি ভেদ করে গেল তাঁর কণ্ঠ
কবি শান্তভাবে বললেন,
আমি মরবো না!
মিথ্যে কথা, কবিরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হয় না।
চতুর্থ গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তাঁর কপাল
পঞ্চম গুলিতে মড় মড় করে উঠলো কাঠের খুঁটি
ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত
ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল
কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে
জনতা ছুটে এলো কবির রক্ত গায়ে মাথায় মাখতে-
কবি কোনো উল্লাস-ধ্বনি বা হাহাকার কিছুই শুনতে পেলেন না
কবির রক্ত ঘিলু মজ্জা মাটিতে ছিট্কে পড়া মাত্রই
আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো দারুণ তোড়ে
শেষে নিশ্বাস পড়ার আগে কবির ঠোঁট একবার
নড়ে উঠলো কি উঠলো না
কেউ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি।
আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো
মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,
বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!”
জন্মসূত্রে আর্জেন্টিনীয় কিউবান বিপ্লবী চে গেভারার মৃত্যুতে গভীর একাত্মতা বোধ করেছিলেন সুনীল। অপরাধের অংশভাগ নিয়ে লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা ‘চে গুয়েভারার প্রতি’। কী লেখা ছিল সে কবিতায়?
‘বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে।
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে
ছুটে আসে অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’
পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে তাঁর রচনা। তবুও একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, সাহেবরা আমার লেখা না পড়লে আমার কিছু আসে যায় না। আমার বাঙালি পাঠকরা যদি আমার লেখা পড়ে এতেই আমি খুশি। প্রসঙ্গত তিনি উল্লেখ করেন একটি বিশেষ ঘটনার কথা : “আমি জার্মানিতে বইমেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে এক সাহিত্য সভায় শুনলাম বার্লিন থেকে এসে একটি মেয়ে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি হয়েছে। তার এক হাতে আইভি দেওয়া হচ্ছে। অন্য হাতটি ডাক্তারকে বলে মুক্ত রেখেছে। কারণ হিসেবে সে উল্লেখ করেছে, বাকি হাতটি দিয়ে আমি যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ বইটি পড়ে শেষ করতে পারি এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি। এর চেয়ে বড় পাওনা একজন লেখকের পক্ষে আর কী হতে পারে?”
এভাবেই যুগে যুগে কবি ও লেখকদের সবচেয়ে বড় পুরস্কার আঁতেল ও উন্নাসিক গবেষকেরা নয়, সাধারণ রসগ্রাহী পাঠকেরাই দিয়ে থাকেন।
সূত্র দি ওয়াল