কামরুল ইসলাম: ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে পুরোপুরিভাবে সাংবাদিকতা পেশায় প্রথম যখন পা রাখি, তখনও জানতাম না খবর মানে কেবল তথ্য নয়, খবর মানে একেকটা মানুষের মুখ, একেকটা কণ্ঠস্বর, আর অগুনতি স্মৃতির সমাহার।
সেই শুরুর দিনগুলোতে মনে হতো, জনসংযোগ কর্মকর্তারাই বুঝি সবকিছুর চাবিকাঠি। মনে হতো, ওঁরা বুঝি খবর ছেঁকে এনে হাতে তুলে দেবেন, যেন একেকটা তাজা পত্রিকা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন সকালে।
এই ধারণার পথ ধরেই পরিচয় হয়েছিল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (জনসংযোগ) এ কে শামস-উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। এক দুপুরে আমাকে ডেকে বলেছিলেন, “একটা বিষয় আছে, তুমি লিখতে পারো।”
সেই খবর ছিল একেবারে টাটকা। পৌরসভার বিদ্যুৎ বিল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা টানাপড়েন। বাণিজ্যিক রেটে পাঠানো বিল, আর পৌরসভার সাধারণ হারে পরিশোধ। দুই পক্ষের এই লড়াই যেন এক চোরাগোপ্তা যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল।
আমি খোঁজ করতে নেমেছিলাম, কথা বলেছিলাম বিভিন্ন পৌরসভার চেয়ারম্যানদের সঙ্গে। সে সময়ে রাজধানীর এক পৌরসভার চেয়ারম্যান বলেছিলেন “পিডিবি যদি সংযোগ কেটে দেয়, আমরা বিদ্যুতের খুঁটি পর্যন্ত উপড়ে ফেলবো! তারা আমার জায়গায় খুঁটি গেড়ে ব্যবসা করছে। ”
সে রিপোর্ট লেখার পর টের পেয়েছিলাম, জনসংযোগ কর্মকর্তা কেবল তথ্যদাতা নন, অনেক সময় একজন নির্ভরতার ঠিকানা। শামস-উদ্দিন আহমেদ আমার জীবনে প্রথম সেই ধরনের এক চরিত্র হয়ে ওঠেন।

চট্টগ্রামে এসে যাঁর সঙ্গে গড়ে উঠেছিল আজীবনের আত্মিক বন্ধন, তিনি এ এস এম বজলুল হক। ডাক নাম রানা। তিনিও সেই পিডিবির সহকারি পরিচালক ছিলেন তখন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক এমন জায়গায় গিয়েছিল, যেখানে সংবাদ বা দাপ্তরিকতা বলে কিছু ছিল না, ছিল কেবল মানুষে মানুষে টান। আজও তিনি সেই ‘হরিহর আত্মা’।
রেলওয়ের শফিকুল আলম খান ( অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক) ছিলেন যেন এক নিজস্ব কিংবদন্তি। সিআরবির নিচে ক্ষুদ্র এক কক্ষে বসতেন তিনি। সেই কক্ষটিই হয়ে উঠেছিল তখনকার সংবাদকর্মীদের আড্ডাস্থল, ছোট প্রেসক্লাব।
চায়ের কাপ, গরম সিঙ্গারা আর হালকা রসিকতায় দিন কেটে যেতো। তাঁর কক্ষটায় শুধু খবর নয়, শেয়ার হতো অভিজ্ঞতা, গড়ে উঠত বন্ধুত্ব।
সে সময়ে পদে ছোট হলেও তিনি ছিলেন দূরদর্শী, দাপুটে কর্মকর্তা। রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার আসজাদ আলীর সাথে সাংবাদিকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে দেন। সাংবাদিকদের কেউ কেউ রেলের কার্ড পাশ পেয়েছিলেন। আমার মতো অনেকেই সেবার সুযোগ পেয়েছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচে রেল ভ্রমণের।

একজন সাংবাদিক হিসেবে যত এগিয়েছি, বুঝেছি—জনসংযোগ কর্মকর্তা মানে কেবল ভালো খবর প্রচার করা নয়, অনেক সময় চাপা দিতে হয় খারাপ খবর। এ এক ভারসাম্যের খেলা। তাঁদের কাজটা অনেকটা ধূসর আকাশে সূর্য খোঁজার মতো। যেন আলো যতটা টেনে আনা যায়, ততটাই জয়। আর মেঘের আড়ালে যেটুকু ঢেকে রাখা যায়, তাও তাঁদের কৌশলের অংশ।
বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে মিডিয়া অ্যাডভাইজাররা আছেন। যাঁদের দায়িত্ব আরও সূক্ষ্ম। প্রবীণ সাংবাদিক কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এই পদে আসেন। তাদের কাজ প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা। ভাবমূর্তির দূর্গ যেন অটুট থাকে, মিডিয়ায় যেন না আসে এক ফোঁটা নেতিবাচকতা।
একবার এক মিডিয়া অ্যাডভাইজার বলেছিলেন: “আমরা খবর লুকাই না, শুধু সময়ের আগে তাকে আলোতে আনতে দেই না।”
তাঁদের কাজটা তখন একধরনের কৌশলী কাব্য, একরকম মিডিয়া-মার্কেটিং সমীকরণ।
চট্টগ্রাম বন্দরে সচিব পদে যাঁরা ছিলেন প্রয়াত এ কে মান্নান, সৈয়দ ফরহাদ উদ্দিন, বা তাঁদের পূর্বসূরিরা—তাঁরাও জনসংযোগের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ, প্রায় পারিবারিক। অনেক সময় রাতে ফোন দিয়ে বলা হতো, “কাল পত্রিকায় একটু দেখে দিও—আমরা ব্যাখ্যাটা ঠিকভাবে দিয়েছি কিনা।”
এইসব সম্পর্ক কেবল পেশাগত ছিল না। সাংবাদিক ও জনসংযোগ কর্মী দুজন যেন একে অন্যের পরিপূরক।
একজন খোঁজেন প্রশ্ন, আরেকজন দাঁড়ান উত্তর নিয়ে। একজন লেখেন বাস্তবতা, আরেকজন সাজান তথ্যের অলংকারে।
এই দুইয়ের মিলনেই তৈরি হয় পাঠকের জন্য সত্য, সংবাদের জন্য পরিপূর্ণতা।
আজও ফিরে তাকালে, মনে হয় পেশাটা শুধু একটা চাকরি ছিল না, ছিল এক ধরনের জীবন্ত সম্পর্কের জাল।
আর সেই জালের প্রতিটি গিঁট বাঁধা ছিল শামস-উদ্দিন, বজলুল হক, শফিকুল আলম খানের মতো জনসংযোগ সৈনিকদের হাতে।
সময় বদলায়, প্রতিষ্ঠান বদলায়, মানুষ বদলায়। কিন্তু কিছু সম্পর্ক সময়ের ছাপ মুছে ফেলতে পারে না। সাংবাদিকতা ছিল আমার পেশা, আর সেই পথচলায় যাঁরা আমার পাশে ছিলেন তাঁরা হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের অংশ।
তথ্য জোগাড়ের চেয়ে বড় ছিল তাঁদের সঙ্গে গড়ে ওঠা মানবিক সংযোগ।
আজও যখন কোনো জনসংযোগ কর্মকর্তার নাম শুনি, অজান্তেই মনে পড়ে শামস-উদ্দিনের ভরসার চোখ, বজলুল হকের ফোনকল, আর শফিকুল আলম খানের হাসিমাখা কক্ষ। সাংবাদিকতা তখন শুধু পেশা ছিল না, একটা আত্মিক অভিজ্ঞতা।