Home অন্যান্য ফুলন দেবী: দস্যুরানী থেকে সংসদ সদস্য

ফুলন দেবী: দস্যুরানী থেকে সংসদ সদস্য

ফুলন দেবী

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

নামকরা মহিলা দস্যু থেকে পরবর্তীকালে সমাজবাদী পার্টির পতাকাতলে দাঁড়িয়ে নারী অধিকার কর্মীরূপে কাজ করেন এবং আরও পরে সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন ফুলন দেবী । ভাগ্যের ফেরে ডাকাতদলের হাতে পড়েন, ধর্ষিতা হন এবং ঘটনাচক্রে একসময় নিজেই এক দস্যুদলের গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে ওঠেন। যদিও তারপরেও তাঁর জীবনে অন্ধকার ঘনিয়েছে পুনরায়। বেহমাই গ্রামের উচ্চবর্ণের ঠাকুরেরা তাঁকে বন্দী করে ধর্ষণ করেছিল। তারই প্রতিশোধ নিতে ফুলন দেবী ফিরে আসেন এবং বেহমাই গ্রামের বাইশজন যুবককে ধরে এনে তাঁদের হত্যার নির্দেশ দেন৷ এই হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নিতেই শের সিং রানা দলবল নিয়ে ফুলন দেবীকে গুলি করে হত্যা করেছিল বলেই জানিয়েছে পুলিশের কাছে। এই ঘটনাই ফুলন দেবী হত্যাকান্ড নামে পরিচিত। শেষপর্যন্ত শের সিংয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।

‘দস্যুরানী’ হিসেবে খ্যাত ফুলন দেবীর জন্ম হয় উত্তরপ্রদেশের জালাউন জেলায়, ১৯৬৩ সালের ১০ আগস্ট। মাত্র ১১ বছর বয়সে বিবাহ হয়েছিল তাঁর, ৩০ বছর বয়সী পুট্টিলালের সঙ্গে। বিয়ের পর স্বামী সম্মতির পরোয়া না করে প্রায় নিয়মিত যৌন নির্যাতন চালাতে থাকে তাঁর ওপর। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিশোরী ফুলনের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেলে তিনি চলে আসেন বাপের বাড়িতে। সেসময় বড়োভাই মায়াদীনের চক্রান্তে কারাবাস হয় তাঁর। তিনদিন কারাগারে থাকার সময়ে পুলিশের দ্বারাই ধর্ষিতা হন ফুলন। জেল থেকে বেরিয়ে সমাজের ছিছিক্কারের ভয়ে বাধ্য হয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসেন, কিন্তু নিয়তির ফেরে সেখানকার দরজাও তাঁর জন্য বন্ধ হয়ে যায় একসময়। অতঃপর এক আত্মীয়ের সাহায্যে ডাকাতদলে যোগ দেন তিনি। কিন্তু ডাকাতদলের সর্দার বাবু গুজ্জর এবং তাঁর অনুচরেরা লাগাতার তিনদিন ধরে ধর্ষণ করে তাঁকে। শেষপর্যন্ত সেই দলেরই বিক্রম মাল্লার সহায়তায় রক্ষা পায় ফুলন এবং বিক্রম হত্যা করে দলের সর্দারকে।

ডাকাতদলে যোগ দিয়ে নিজের স্বামীকে হত্যার চেষ্টা করেন ফুলন দেবী, যদিও পুট্টিলাল ছুরিকাঘাতের পরেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল৷বিক্রম মাল্লার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় ফুলনের। বিক্রমের কাছ থেকেই তিনি রাইফেলের ব্যবহার শেখেন এবং বুন্দেলখন্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে একটি গ্যাং-এর কার্যকলাপে অংশ নেন। এরপর ভাগ্যদোষে ফুলনকে বন্দী করে রাখা হয় বেহমাই গ্রামে এবং সেখানে উচ্চবর্ণের হিন্দু ঠাকুরেরা তিনদিন ধরে ধর্ষণ করে তাঁকে। এমনকি চুড়ান্ত অবজ্ঞায় তাঁকে নগ্ন করে গ্রামের চারপাশে ঘোারাতেও কুন্ঠিত হয় না। এরপর মান সিংয়ের সঙ্গে মাল্লাদের নিয়ে এক দল গঠন করেন তিনি। উচ্চবর্গের লোকেদের সম্পত্তি লুঠ করে বিলিয়ে দিতে থাকেন নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে।

বেহমাই গ্রামে তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের কথা ফুলন ভুলতে পারেননি। ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নিজের দলবল সহকারে ফুলন বেহমাই গ্রামে প্রবেশ করেন। মোট কুড়ি জনকে তিনি হত্যা করেছিলেন সেদিন। সেই কুড়ি জনের মধ্যে সতেরো জন ছিলেন ঠাকুর। এই প্রতিশোধ সারা দেশে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভিপি সিং পদত্যাগও করেছিলেন। পরে যদিও আত্মসমর্পণ করেন তিনি। মুক্তি পেয়ে বিবাহ করেন এমনকি মুলায়েম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টির তরফে উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন ফুলন। নির্বাচনে জয়ী সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিতও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বেহমাই গ্রামের হত্যাকান্ড তাঁর জীবনে অন্ধকার নামিয়ে এনেছিল।

২০০১ সালের ২৫ জুলাই। ফুলন দেবীর বয়স তখন ৩৭ বছর। লোকসভার কাজ সমাধা করে দুপুরবেলা মধ্যাহ্নভোজনের সময় তিনি ফিরেছিলেন দিল্লির অশোকা রোডে নিজের বাড়িতে। সেই বাংলোর বাইরেই ১.৩০টার সময়ে তিনজন বন্দুকধারী তাঁর মাথায়, বুকে কাঁধে এবং ডানহাতে মোট নয়বার গুলিবিদ্ধ করে তাঁকে। ফুলনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী বালিন্দর সিংকেও ডান বুকে এবং ডান হাতে গুলি করে আততায়ীরা। হত্যাকান্ড সমাধা করবার পর তাঁরা তিনজন একটি মারুতি ৮০০ গাড়িতে করে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কোনো কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বলে থাকেন যে তিনজনের একজন গাড়ি চালাচ্ছিলেন এবং বাকি দুজনের হাতে ছিল পিস্তল। মাঝপথে আততায়ীরা নাকি মারুতিটি ছেড়ে দিয়ে অটোরিকশাতে করে পালিয়েছিলেন। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ওয়েবলি অ্যান্ড স্কট পিস্তল, ইম্প্রোভাইজড আগ্নেয়াস্ত্র এবং আইওএফ.৩২ রিভলবার পেয়েছিল। আহত ফুলন দেবীকে তৎক্ষনাৎ রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

এই নির্মম হত্যাকান্ডের মূল পান্ডা ছিলেন ৩৮ বছর বয়সী শের সিং রানা। তিনি নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। নিজে পুলিশকে বলেছিলেন যে ১৯৮১ সালে বেহমাইতে উচ্চবর্ণের মানুষদের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই ফুলন দেবীকে হত্যা করেছেন তিনি। এরপর এই হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে আদালতে বসে বিচারসভা। দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর বিচার চলবার পর আদালত অবশেষে ২০১৪ সালের ১৪ অগাস্ট শের সিং রানাকে ভারতীয় দন্ডবিধির ৩০২, ৩০৭ এবং ৩৪ নম্বর ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করেছিল। এক লক্ষ টাকা জরিমানাও করা হয়েছিল তার। তবে অতিরিক্ত দায়রা জজ ভারত পরাশর অন্য দশজন অভিযুক্তকে খালাস দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাণা প্রশ্ন তুলেছিল কেন শুধু একা তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে! বিচারক অবশ্য বলেছিলেন শের সিং চাইলে উচ্চ আদালতেও আপিল করতে পারেন। যে দশজনকে আদালত মুক্তি দিয়েছিল তাঁরা হলেন ধনপ্রকাশ, শেখর সিং, রাজবীর সিং, বিজয় সিং, রাজেন্দ্র সিং ওরফে রবিন্দর সিং, কেশব চৌহান, প্রবীণ মিত্তাল, অমিত রাঠি, সুরেন্দর সিং নেগি এবং শরাবন কুমার। ২৪ অক্টোবর ২০১৬ সালে যদিও জামিনে খালাস পেয়ে যান শের সিং রানা।